বুক রিভিউঃ শঙ্খচূড়
'শঙ্খচূড়'
- সাদাত হোসাইন
গ্রিক উপাখ্যানে বর্ণিত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো ট্রোজান যুদ্ধ। এই যুদ্ধ গ্রিক পুরাণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কথিত আছে, দেবরাজ জিউস নাকি মনে করতেন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে গেছে, তাই তা কমানোর দরকার। এজন্য তিনি তার কূটকৌশলের মাধ্যমে একটি যুদ্ধ বাঁধানোর চেষ্টা করেন যাতে মানুষের সংখ্যা কমে যায়। এই যুদ্ধ গ্রিক ও ট্রোজানদের মধ্যে সংঘটিত হলেও এর পটভূমি শুরু হয় গ্রিক মিথোলজির দেব-দেবীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে।
ট্রোজান যুদ্ধের এ কাহিনীর শুরু গ্রিক বীর অ্যাকেলিসের খুনে ক্রোধের ঘোষণা রেখে, আর শেষ ট্রোজান বীর হেক্টরের অন্তেষ্টিক্রিয়ায়। এর মাঝে রাজসিক পংক্তিগুলিতে রক্ত ঝরিয়ে হেঁটে চলেছে কিংবদন্তি ট্রোজান বীরেরা: প্রায়াম, হেক্টর, প্যারিস ঈনিয়াস; এবং গ্রিক পক্ষে অ্যাকেলিস, অ্যাজেক্স, আগামেমনেস সহ আরও অনেকে। আর ট্রয়ের নগরপ্রকারের ওপর দাঁড়িয়ে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখছে এক পরমা সুন্দরী রানী, নাম তার হেলেন — তাকে কেন্দ্র করেই শুরু এ সবকিছুর। সেই সঙ্গে মানুষের এ যুদ্ধক্ষেত্রের ওপরে দীর্ঘ ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে দেবিদেবীরাও: জিউস, পসাইডন, অ্যাপেলো, যার যার স্বার্থ নিয়ে।
প্রেম, কাম, ক্রোধ, যুদ্ধ, প্রতিহিংসা, রাজনীতি, ষড়যন্ত্র ও সততার এক সর্ব বিস্তারী রুদ্ধশ্বাস রাজকীয় আখ্যান 'শঙ্খচূড়'। এ উপাখ্যানের শুরু রাজমাতা অন্নপূর্ণার ক্রোধের আগুনে পুড়ে আর সমাপ্তি রাজবধূ পুষ্পলতার ইজ্জত নিলামে চড়িয়ে। এর মাঝে রাজকীয় অশ্ব ছুটে চলেছে রাজা বিজয়াদিত্য, রানী বিভাবতী, রাজমাতা অন্নপূর্ণা দেবী, যুবরাজ অরুণাদিত্য, রাজভ্রাতা বিনয়াদিত্য, সেনাপতি অক্ষয়াদিত্য, চিত্রলেখা, রাজকুমারী সৃজিতা, রাজকুমারী পুষ্পলতা, গৌড়ী, কৃষ্ণেন্দু মিত্র, অরিন্দম মিত্র গল্প নিয়ে। আর এই রাজকীয় যুদ্ধ, হিংস, রাজনীতি সবই নিরব দৃষ্টিতে পরোখ করছে এক রত্নখচিত সিংহাসন, কারণ তাকে ঘিরেই যে এত এত উপখ্যান। পুরো উপাখ্যানে ছায়া সঙ্গী হিসেবে ভ্রমণ করছে আরও দুজন চরিত্র, দস্যু বনপতি; রত্নেশ্বর ঠাকুর, তাদেরও আছে স্ব স্ব স্বার্থ। ❝রাজকীয় এ উপখ্যানে শুধু একটা প্রতিশ্রুতিই সত্য, বাকি সব মিথ্যে, এখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও প্রতিশ্রুতি রাখার প্রতিশ্রুতি নেই।❞
➲ আখ্যান—
"ভালোবাসা এমন কেন? কেন কেউ বুকের ভেতর এমন আলগোছে চুপিচুপি শেকড় গজিয়ে ফেলে? আর সেই শেকড় উপড়ে ফেলতে গেলেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বুকের জমিন। ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে হৃদয়ভূমি। এ কেমন অনুভব?" "বেশিরভাগ মানুষের ঔদ্ধত্য কোথা থেকে তৈরি হয় জানো?”
"কোথা থেকে?"
“নিজের নির্বুদ্ধিতা আর অন্যের বিনয় থেকে।"
"মানে?"
“মানে বুদ্ধিমান মানুষ উদ্ধত হয় না। উদ্ধত হয় নির্বোধ লোক। বেশিরভাগ নির্বোধই অন্যের বিনয়কে দুর্বলতা ভাবে। আর কাউকে দুর্বল ভাবা মাত্রই সে হয়ে ওঠে উদ্ধত। আর উদ্ধত মানুষ মাত্রই নিজেকে অতি-আত্মবিশ্বাসী এবং অতিসক্ষম মনে করা শুরু করে। সমস্যা হচ্ছে, এটি তার ভেতরে অবচেতনেই অন্যের সক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়। আর ভুল যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন পতন অনিবার্য।"
➤ পাঠ প্রতিক্রিয়া —
❝যে বইটা পড়ার পর বইটা আবারও পড়ার জন্য আগ্রহ জাগে না সে বইটা আমার কাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ না। যে বইটা পড়ার পর কিছুক্ষণের জন্যেও আমি স্তব্ধ হয়ে থাকি না সে বইটা আমার কাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ না। যে কাহিনী পড়ার সময় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয় না সে কাহিনী আমার কাছে পার্ফেক্ট থ্রিলার না।❞ — ❛শঙ্খচূড়❜ পড়ার সময় কিংবা পড়ার পর উপরের তিনটা অনুভূতিই কাজ করেছে। বইটা শেষ করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। কোনোভাবেই কাহিনীটাকে মাথা থেকে সড়াতে পারছিলাম না। বইয়ের ভাজে ভাজে থাকা প্রশ্নগুলো আমাকে ভাবাচ্ছিলো। দাবার ছকের মতো পরবর্তী চালগুলো ভাবছিলাম।
❛শঙ্খচূড়❜ পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো রোলার কোস্টার রাইড দিচ্ছি। ঘটনাপ্রবাহ এত দ্রুত আগাচ্ছিলো কাহিনী ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। একের পর এক টুইস্ট, একের পর এক মোড়! কাকে ভরসা করব তা-ই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবচেয়ে দূর্বল চরিত্রও হুট করে এত শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছিলো, পুরো ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছিলো। গল্পটার শেষ কোথায় হবে তা-ই মিলাতে পারছিলাম না৷
● সূত্রপাত—
একটা বই পাঠককে আটকে রাখতে সূত্রপাত অনেক বড় ভূমিকা রাখে। বইয়ের সূত্রপাতই যদি ম্যাড়মেড়ে হয় তবে অনেক পাঠকই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সামনে আগানোর। এমনও অনেক সময় দেখা যায় অনেক ভালো বই পাঠক ফেলে রাখে শুরুটা ভালো না হওয়ায়। কিন্তু ❛শঙ্খচূড়❜ এর সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম। শুরু থেকেই যেভাবে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছে এই বই তাতে পাঠক এক মুহুর্তের জন্য কাহিনী ছেড়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। রাজা বিজয়াদীত্যের অসুস্থতা এবং রাজমাতা অন্নপূর্ণা দেবীর নেয়া কঠিন সিদ্ধান্ত পাঠক মনে প্রশ্নের উদ্রেক করবে, এরপর চন্দ্রগড়ের রাজ সিংহাসন কার হবে? এই প্রশ্নই একজন পাঠককে পুরো বইয়ে চুম্বকের মতো আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট।
● গল্প বুনট—
নাটকীয় সংঘাত, অপ্রত্যাশিত ভাবে গল্পের মোড় পরিবর্তন ❛শঙ্খচূড়❜ উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যা প্রশংসার দাবিদার। কৃষ্ণেন্দ মিত্রের ছেলে অরিন্দম মিত্রের জিহবা কর্তনের পূর্ব পর্যন্ত ❛শঙ্খচূড়❜ ছিল একটি লঘু রাজনৈতিক কাহিনী। তার পরেই বইটি গুরুগম্ভীর রূপ ধারণ করে। বিনয়াদিত্য আর সৃজিতার বিয়ের এক মাস পর অরুণাদিত্যের আগমনে পাঠক মনে আবার আশা জাগে মিলনান্তক পরিণতির। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ অভাবিত ভাবে ভিন্ন খাতে বয়ে যায়, আশা পরিণত হয় হতাশায়। বইয়ের প্রতিটা অধ্যায়ে আমার কানে শুধু একটা বাক্যই প্রতিধ্বনিত হয়েছে, ❝বিশ্বাস মূলত একটি অবিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার। তাই বিশ্বাসের মতো অবিশ্বাসযোগ্য একটি বিষয়ে যত কম বিশ্বাস রাখা যায়, তত ভালো।'❞ বইয়ের প্রতি পাতায় উন্মোচিত নতুন নতুন সত্য শুধু উপরের লাইনের উপর বিশ্বাস আনতে আরও বেশি বাধ্য করেছে। শেষ পর্যন্ত বিনয়াদিত্যের বিশ্বাসঘাতকতার একটা তিক্ত ছাপ থেকে যাবে যেকোনো পাঠক মনে।
● লেখনশৈলী
প্রতিটা লেখকের লিখনশৈলী ভিন্ন। লিখনশৈলীর মাধ্যমেই একজন লেখককে আলাদা করা যায় অন্য লেখকের থেকে। ❛শেষ অধ্যায় নেই❜ বইয়ের মাধ্যমেই পরিচিত হয়েছিলাম সাদাত হোসাইনের লেখনশৈলীর সাথে। তবে ❛শঙ্খচূড়❜ বইটা পড়ার সময় মনে হয়েছে লেখকের লেখার মাঝে আমূল পরিবর্তন না আসলেও চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন এসেছে। উন্নত হয়েছে আগের চেয়ে। ভিন্নতা এসেছে বাক্যগঠনে। হুমায়ুন আহমেদের ❝বাদশাহ নামদার❞ বইয়ের লেখনশৈলীর যে ছাঁচে গড়া ক্ষনিকের জন্য মনে হলো বইয়ের লেখনশৈলীও সে ছাঁচেই গড়া। এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেলা যায়।
● বর্ণনা—
খুব সাধারণ একটা কাহিনীও পাঠকমনে দাগ কেটে যায় চমৎকার বর্ণনায় আবার অনেক অসাধারণ কাহিনীও পাঠকমনে বিরক্তির উদ্রেক সৃষ্টি করে অবান্তর বর্ণনার দরুন। ❛শঙ্খচূড়❜ উপন্যাসটি এত দ্রুত টাইমলাইন পরিবর্তন করছিলো আর কাহিনী এত জটিল ভাবে এগুচ্ছিলো যে বর্ণনার দিকে সেভাবে নজরই পড়েনি। তবে লেখক চাইলে প্রথম অর্ধ্বাংশকেই আরও বিস্তারিত লিখতে পারতেন। বইটাতে আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলে ভালো লাগতো। ঠিক এই যায়গাটাতেই মনে হয়েছে লেখায় বর্ণনার কিছুটা ঘাটতি আছে। ছোট ছোট কিছু ঘটনাতে বর্ণনা আর একটু বৃদ্ধি করলে বইটা আরো বেশি জীবন্ত মনে হতো। গল্প একই রেখে অন্তত একশো পেইজ বৃদ্ধি করা যেত শো ডোন্ট টেল এর মাধ্যমে। বইয়ের একমাত্র খামতি হিসেবে আমি বর্ণনাকেই দায়ী করব।
● ভাষা—
❛শঙ্খচূড়❜ - কথ্য ভাষায় রচিত। লেখকের টানা গদ্যে প্রাণের সমাহার হিংসনীয়। বাক্যের ভাজে ভাজে পাঠকমন বিমোহিত। লেখক ছোট ছোট বাক্যের ব্যবহার করেছেন দৃষ্টিনন্দন ভঙ্গিতে। তাই পড়ার সময় ক্লান্তি অনুপস্থিত। মাঝেমাঝে বড় বাক্যও লক্ষ্য করা যায় তবে তা বিরক্তির উদ্রেক সৃষ্টিতো করেইনি বরঞ্চ পুরো লেখার মাঝে একটা সাবলীলতা বজায় রেখেছে। এই উপন্যাসের ভাষা চরিত্রানুগ, বেশ কিছু চরিত্র কথা বলেছে যাজকোচিত উপদেশগম্ভীর ভাষায়। একই চরিত্রের সংলাপ পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। এছাড়া কিছু চরিত্রের সংলাপ আবেগের একতারায় ঝংকার তুলেছে নিদারুণ ভাবে। লেখকের শব্দ ভাণ্ডার নজর কাড়বে যেকোনো পাঠকের। এতে পাঠক আর যাই হোক, বিরক্তিবোধ করবে না।
● চরিত্রায়ন—
একটা রাজ্য পরিচালনা করার জন্য যেমন অনেক মানুষের প্রয়োজন তেমনই একটা রাজকীয় উপাখ্যান লেখার জন্যেও অনেকগুলো মূল চরিত্র এবং পার্শ্ব চরিত্র প্রয়োজন। ❛শঙ্খচূড়❜- এর ব্যতিক্রম না। গল্পের প্রয়োজনে বেশ অনেক চরিত্রই এসেছে। কোনো চরিত্রের উপস্থিতি ক্ষনিকের আবার কোনো চরিত্রের পুরো কাহিনী জুড়ে। এ গল্পের নায়ক কে আর খলনায়ক কে তা আমি খুঁজে বের করতে পারিনি। প্রতিটা চরিত্রের দাবি যেমন যুক্তিসঙ্গত তেমনই তাদের কর্মকাণ্ড নিন্দনীয়। এ উপাখ্যানে সবচেয়ে বেশি মেলে ধরা হয়েছে রাজমাতা অন্নপূর্ণা দেবীকে। কেবল এই চরিত্রটাকেই পূর্ণাঙ্গ মনে হয়েছে। রাজা বিজয়াদিত্য, দস্যু বনপতি এবং রত্নেশ্বর ঠাকুর সবচেয়ে ধোঁয়াশাপূর্ণ চরিত্র। তবে আমার কেন যেন মনে হয়েছে যুবরাজ অরুণাদিত্য চরিত্রটা পূর্ণাঙ্গ না। পুষ্পলতার দিকেও আরও বেশি সময় দেয়া যেত। ❛শঙ্খচূড়❜- উপন্যাসে সবচেয়ে বেশি চমকে দিয়েছে রাজভ্রাতা বিনয়াদিত্য এবং রাজকুমারী সৃজিতা। ঠিক তাদের কাছে এসেই আমার মনে একটা সুর বাজছিলো, ❝পৃথিবীতে সকলেই কমবেশি বিশ্বাস ভাঙে। কিন্তু তার চেয়ে জঘন্য মানুষ আর হয় না, যে তার সেই বন্ধুর বিশ্বাস ভাঙে, যে বন্ধু তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।❞
● অবসান—
❝অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি’ মনে হবে,
শেষ হইয়াও হইল না শেষ!❞
কবিগুরু যেন এই দুটি লাইন লিখেছেন ❛শঙ্খচূড়❜ বইটার জন্য-ই। পাঠকমনে অতৃপ্তির বীণা বাজিয়েই বইটার সমাপ্তি টেনেছেন লেখক সাহেব। ফাটল ধরা ফসলি জমি যেমন বৃষ্টির অপেক্ষায় প্রহর গুনে তেমনই আমার বুভুক্ষু হৃদয় অপেক্ষায় ছিলো মধুর সমাপ্তির। কিন্তু বইয়ের অন্তঃ ঘটল কীভাবে? এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসীমপানে তাকিয়ে আপনাকে শান্তনা দেই, ❝সব গল্প সুখের নয়, কিছু গল্প বেদনায় সিক্ত হয়❞। লেখক গল্পের খাতিরে সমাপ্তি টেনেছেন ঠিকই কিন্তু পাঠক মনে অপ্রাপ্তির ছাপ থেকে যাবে বহুকাল। তবে পাঠক চাইলে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির এই জটিল গাণিতিক সমস্যাটা রেখে দিতে পারেন ❛শঙ্খচূড়❜ বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডের জন্য। কেননা লেখক বইয়ের শেষাংশে গোটা গোটা অক্ষরে ঘোষণা দিয়েছেন পরবর্তী খন্ডের।
● খুচরা আলাপ—
বই আমাদের অনেক পাঠই দেয়, কিন্তু বইয়ের চেয়েও বেশি পাঠ দিয়ে থাকে ❝কষ্ট❞ নামক শব্দটা। ❛শঙ্খচূড়❜ পড়ার পর বিষয়টি আরও বেশি উপলব্ধি করলাম। অরুণাদিত্য যখন সৃজিতাকে বলছিলো, ❝সবাই ভাবে বয়স মানুষকে বড় বানায়, কথাটা সত্য না। মানুষকে কী বড় বানায় জানো? কষ্ট।❞ তখন নিজের জীবনের সাথে মেলানোর চেষ্টা করলাম। বাক্যটা খাপে খাপ মিলে গেলো। আমাদের জীবনে অনেক সময় অনেক ধরনের কষ্ট আসে, আর সেই কষ্টই আমাদের শক্ত হতে সাহায্য করে। বইয়ের মাঝপথে সৃজীতার প্রতি অরুণের ভালোবাসা দেখে খুব খারাপই লাগছিলো। কিন্তু কিচ্ছুক্ষণ পরেই আরও একটা জীবন পাঠ পেলাম। রত্নেশ্বর ঠাকুরের বলা কথা গুলো, ❝যা তোমার নয়, তা তুমি পেয়ে গেলেও তোমার নয়। আর যা তোমার, তা তুমি না পেলেও তা চিরকাল তোমারই। সুতরাং কারও ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে পেতে চেয়ো না। বরং ছেড়ে দাও। মুক্ত করে দাও। মনে রেখো, কখনো কখনো মুক্তিই বন্দীত্ব। আবার কখনো বন্দীত্বই মুক্তি।❞ এর সত্যতা উপলব্ধি করলাম অরুণাদিত্যের প্রতি পুষ্পলতার ভালোবাসা দেখে।
———
প্রতিটা রাজকীয় উপখ্যান থেকে আমি কোনো না কোনো জীবনদর্শন পেয়েছি। এ ধরনের কাহিনির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে দর্শনশাস্ত্র। অমিশ ত্রিপাঠীর শিব ট্রিলজি আর রামচন্দ্র সিরিজ দিয়েই এধরণের বইয়ের সাথে আমার পরিচয়। বইয়ের কন্সেপ্ট মুগ্ধ করতে না পারলেও দর্শনশাস্ত্র ঠিকই মুগ্ধ করে ছিলো। ❛শঙ্খচূড়❜ - বইয়ের প্রতি মুগ্ধতা কাজ করার আর একটা অন্যতম কারণ ছিলো দর্শনশাস্ত্র। অনেক সংলাপের সাথে পূর্ব পরিচিত থাকলেও রত্নেশ্বর ঠাকুরের বলা সংলাপ, ❝তুমি ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছ বা দুর্বল হয়ে গেছ, সেটা কাউকে বুঝতে দিয়ো না। কারণ, মানুষ ভেঙে যাওয়া বাড়ির ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়❞ আমার জীবনবোধকে আর একটু সমৃদ্ধ করেছে। সত্যিইতো আমরা বুঝে কিংবা না বুঝে অপরের কাছে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করে ফেলি। আর মানুষ সেই দূর্বলতারই সুযোগ নেয়।
➣ লেখক নিয়ে কিছু কথা—
❝বৃক্ষ তোমার নাম কী?
ফলে পরিচয়!❞
একজনের লেখকের পরিচয় তার লেখার মাঝে। সাদাত হোসাইনও তার ব্যাতিক্রম নন। লেখার মাধ্যমে যায়গা করে নিয়েছেন হাজারো পাঠকের মন পিঞ্জিরায়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই দিঘির ❝যেতে চাইলে যেও❞, যা প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। আর তারপর যেন তাঁর লেখক সত্ত্বা আরো প্রকট রূপ লাভ করে, কলম যেন হয়ে উঠে খাপছাড়া তলোয়ার। এক এক করে প্রকাশিত হয় পঁচিশটি গ্রন্থ। প্রতিটা গ্রন্থই পাঠকমহলে হিংসনীয় পর্যায়ের সাড়া ফেলে। লেখকের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ❛শঙ্খচূড়❜।
● সম্পাদনা ও বানান—
বইটার কাহিনী এত দ্রুত এগুচ্ছিলো যে বানানের দিকে আলাদা ভাবে নজর দেয়ার সুযোগই হয়নি। তারপরও কয়েকটা ভুল বানান চোখে পড়েছে। বাংলা একাডেমি যেহেতু প্রতি মাসেই কিছু না কিছু শব্দের পরিবর্তন আনছে তাই এই ভুল বানানগুলোকে ভুলের খাতায় না আনলেও চলবে।
● প্রোডাকশন—
অন্যপ্রকাশের প্রোডাকশনের দিকে আঙুল তোলা আর বোকার স্বর্গে বাস করা সমতূল্য। তাই এ দুঃসাহস আমি করব না। ❛শঙ্খচূড়❜ বইয়ে দামি কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। বাধাই হয়েছে মাখনের মতো মোলায়েম। খুব সহজেই পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তে পারছিলাম। আমি ইতিমধ্যে দুইবার পড়ে ফেলেছি বইটা, আশা করা যায় আরও কয়েকবার পড়ার পরেও বাধাইয়ে সমস্যা হবে না। লাইন গ্যাপ এবং ফন্ট স্পেস বইটাকে পড়তে আরো আরাম দেয়। বাহ্যিক প্রোডাকশন এবং অভ্যন্তরীণ কন্সেপ্ট নিয়ে ❛শঙ্খচূড়❜ হয়েছে অনন্য।
● প্রচ্ছদ—
❝আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী❞
উপরোক্ত প্রবাদটি ❛শঙ্খচূড়❜ বইয়ের মাঝে প্রতিফলিত হয় খুব সুন্দর ভাবে। প্রথম দেখাতেই যে কারো নজর কাড়বে এ বইয়ের প্রচ্ছদ। সোনায় মোড়ানো এক ফ্রেমে রাজমুকুট এবং রাজপ্রাসাদের চিত্র। এ চিত্র দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে ক্ষমতার লড়াই হবে পুরো বইয়ে। প্রচ্ছদকার সাদিতউজ্জাম তাঁর প্রচ্ছদের মাঝে সব সময় সেরাটা দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এই বইয়ের প্রচ্ছদে যেন আবেগের ছোঁয়া একটু বেশিই ছিলো। তবে নামলিপিটা আমার সাদামাটা মনে হয়েছে। নামলিপিতে সময় দিলে আরও ভালো কিছু করা সম্ভব হতো। অলংকরণ চোখে পরার মতো না। বইয়ের শোভা বর্ধনের জন্য অলংকরণের প্রয়োজনীয়তা ছিলো ব্যাপক। বইয়ের কন্সেপ্টের সাথে বেশ মানানসই একটা প্রচ্ছদ করেছেন প্রচ্ছদকার। এরজন্য তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য।
⛃ বই : শঙ্খচূড়
⛁ লেখক : সাদাত হোসাইন
⛃ জনরা : ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস
⛁ প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৩
⛃ মূল প্রচ্ছদ : মো. সাদিতউজ্জামান
⛁ প্রকাশনা : অন্যপ্রকাশ
⛃ প্রকাশক : মাজহারুল ইসলাম
⛁ মুদ্রিত মূল্য : ৭০০৳
⛃ পৃষ্ঠা : ৩০৭
লেখা- সরোয়ার হোসাইন

No comments